
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর মুসলিম বিশ্বের শাসনব্যবস্থা যে ধারায় এগিয়ে চলে, তার প্রথম অধ্যায় ছিল খুলাফায়ে রাশেদার গৌরবময় শাসন। এই সময়কালে ইসলাম কেবল ধর্ম হিসেবে নয়, একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা পায়। সাম্য, শান্তি, ন্যায়বিচার এবং ইনসাফের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় এই শাসনামলে, যা ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য এক আদর্শ রূপে বিবেচিত।
খুলাফায়ে রাশেদার পর মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব গ্রহণ করে উমাইয়া রাজবংশ, যার সূচনা হয় ৪১ হিজরিতে। প্রথম খলিফা মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.) রাজধানী হিসেবে দামেস্ক থেকে শাসন শুরু করেন। এই বংশে মোট ১৪ জন খলিফা শাসন করেন, যাদের মধ্যে শেষজন ছিলেন মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদ আল-জাদি।
উমাইয়া খেলাফতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ইসলামের ব্যাপক বিস্তার। তাদের শাসনামলেই আন্দালুসিয়া বিজয়ের মাধ্যমে ইসলাম ইউরোপের মাটিতে প্রবেশ করে। কেবল সামরিক বিজয় নয়, এই সময় নাগরিক জীবন, নগরায়ন, রাস্তা, সেচব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কাঠামোতেও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। উমাইয়ারা প্রথম ইসলামী মুদ্রা চালু করেন, যা ইসলামী অর্থনীতিকে স্বকীয়তা দেয়। বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও অনুবাদ কার্যেও তারা বিশেষ অবদান রাখে, যা ইসলামী জ্ঞানচর্চাকে প্রসারিত করে।
১৩২ হিজরিতে উমাইয়াদের পতনের পর আব্বাসীয় খেলাফতের সূচনা ঘটে। প্রথম খলিফা আবু আল-আব্বাস আস-সাফফাহ থেকে শুরু করে এ যুগকে প্রধানত দুটি পর্বে ভাগ করা হয়: প্রথম পর্ব ছিল গৌরব ও সৃজনশীলতার, দ্বিতীয়টি ছিল অবক্ষয় ও দুর্বলতার।
আব্বাসীয় যুগে খলিফা হারুন আর-রশিদ প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত বাইতুল হিকমা—যা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানকেন্দ্রে পরিণত হয়। অনুবাদ, গবেষণা, বিজ্ঞান ও সাহিত্য চর্চায় এই যুগ হয়ে ওঠে অনন্য। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিলাসিতা ও জিহাদি চেতনার অবসান ঘটে। এই দুর্বলতা মঙ্গোলদের আক্রমণকে সহজতর করে এবং ৬৫৬ হিজরিতে বাগদাদ ধ্বংসের মাধ্যমে আব্বাসীয় খেলাফতের করুণ পরিসমাপ্তি ঘটে।
আব্বাসীয়দের পতনের পর মুসলিম বিশ্বের হাল ধরেন মামলুক শাসকগণ। ৬৪৮ হিজরিতে তাদের শাসনের সূচনা হয়। মূলত সামরিক পটভূমি থেকে উঠে আসা এই শাসকরাই তাতার ও ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে ইতিহাসখ্যাত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বিশেষ করে ৬৯০ হিজরিতে ‘আকর’ পুনর্দখল মামলুকদের এক ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবে বিবেচিত হয়।
তবে পরবর্তীকালে প্লেগ, অভ্যন্তরীণ সংঘাত, দুর্নীতি এবং অনির্ধারিত উত্তরাধিকার মামলুক শাসনকে দুর্বল করে তোলে। শেষ পর্যন্ত ৯২২ হিজরিতে মামলুক রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে।
১২৯৯ সালে যুবরাজ ওসমান বিন এরতুগ্রুল-এর নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করে অটোমান সাম্রাজ্য, যা পরবর্তীতে ইসলামী বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও দীর্ঘস্থায়ী খিলাফতে রূপ নেয়। অটোমান শাসনের শ্রেষ্ঠ অর্জন ছিল কনস্টান্টিনোপল বিজয়, যা ১৪৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ-এর নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়।
অটোমানরা শুধু শাসকই ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন জ্ঞান, স্থাপত্য, চিকিৎসা ও শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী। তবে পরবর্তীতে প্রশাসনিক জটিলতা, প্রযুক্তিগত পিছিয়ে পড়া ও ঋণের বোঝা এই সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে তোলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ১৯২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অটোমান খিলাফতের অবসান ঘটে।
খিলাফতের পতনের পর মুসলিম বিশ্বে শুরু হয় পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসনের যুগ। ইসলামী ভূখণ্ডগুলোকে বিভাজিত করে ছোট ছোট রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। তবে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে এসব দেশ ধীরে ধীরে স্বাধীনতা অর্জন করে।
বর্তমানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর আন্তর্জাতিক সংগঠন ওআইসি (OIC)-এর সদস্য সংখ্যা ৫৭টি। এরা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এর বাইরেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে অগণিত মুসলিম জনগোষ্ঠী—যারা ইসলামী ইতিহাসের উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে চলছে বৈচিত্র্য ও বিস্তারের নতুন ধারায়।
রোববার, ২৪ আগস্ট ২০২৫
প্রকাশের তারিখ : ১৭ জুলাই ২০২৫
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর মুসলিম বিশ্বের শাসনব্যবস্থা যে ধারায় এগিয়ে চলে, তার প্রথম অধ্যায় ছিল খুলাফায়ে রাশেদার গৌরবময় শাসন। এই সময়কালে ইসলাম কেবল ধর্ম হিসেবে নয়, একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠা পায়। সাম্য, শান্তি, ন্যায়বিচার এবং ইনসাফের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় এই শাসনামলে, যা ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য এক আদর্শ রূপে বিবেচিত।
খুলাফায়ে রাশেদার পর মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব গ্রহণ করে উমাইয়া রাজবংশ, যার সূচনা হয় ৪১ হিজরিতে। প্রথম খলিফা মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান (রা.) রাজধানী হিসেবে দামেস্ক থেকে শাসন শুরু করেন। এই বংশে মোট ১৪ জন খলিফা শাসন করেন, যাদের মধ্যে শেষজন ছিলেন মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদ আল-জাদি।
উমাইয়া খেলাফতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ইসলামের ব্যাপক বিস্তার। তাদের শাসনামলেই আন্দালুসিয়া বিজয়ের মাধ্যমে ইসলাম ইউরোপের মাটিতে প্রবেশ করে। কেবল সামরিক বিজয় নয়, এই সময় নাগরিক জীবন, নগরায়ন, রাস্তা, সেচব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কাঠামোতেও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। উমাইয়ারা প্রথম ইসলামী মুদ্রা চালু করেন, যা ইসলামী অর্থনীতিকে স্বকীয়তা দেয়। বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও অনুবাদ কার্যেও তারা বিশেষ অবদান রাখে, যা ইসলামী জ্ঞানচর্চাকে প্রসারিত করে।
১৩২ হিজরিতে উমাইয়াদের পতনের পর আব্বাসীয় খেলাফতের সূচনা ঘটে। প্রথম খলিফা আবু আল-আব্বাস আস-সাফফাহ থেকে শুরু করে এ যুগকে প্রধানত দুটি পর্বে ভাগ করা হয়: প্রথম পর্ব ছিল গৌরব ও সৃজনশীলতার, দ্বিতীয়টি ছিল অবক্ষয় ও দুর্বলতার।
আব্বাসীয় যুগে খলিফা হারুন আর-রশিদ প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত বাইতুল হিকমা—যা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানকেন্দ্রে পরিণত হয়। অনুবাদ, গবেষণা, বিজ্ঞান ও সাহিত্য চর্চায় এই যুগ হয়ে ওঠে অনন্য। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিলাসিতা ও জিহাদি চেতনার অবসান ঘটে। এই দুর্বলতা মঙ্গোলদের আক্রমণকে সহজতর করে এবং ৬৫৬ হিজরিতে বাগদাদ ধ্বংসের মাধ্যমে আব্বাসীয় খেলাফতের করুণ পরিসমাপ্তি ঘটে।
আব্বাসীয়দের পতনের পর মুসলিম বিশ্বের হাল ধরেন মামলুক শাসকগণ। ৬৪৮ হিজরিতে তাদের শাসনের সূচনা হয়। মূলত সামরিক পটভূমি থেকে উঠে আসা এই শাসকরাই তাতার ও ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে ইতিহাসখ্যাত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বিশেষ করে ৬৯০ হিজরিতে ‘আকর’ পুনর্দখল মামলুকদের এক ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবে বিবেচিত হয়।
তবে পরবর্তীকালে প্লেগ, অভ্যন্তরীণ সংঘাত, দুর্নীতি এবং অনির্ধারিত উত্তরাধিকার মামলুক শাসনকে দুর্বল করে তোলে। শেষ পর্যন্ত ৯২২ হিজরিতে মামলুক রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে।
১২৯৯ সালে যুবরাজ ওসমান বিন এরতুগ্রুল-এর নেতৃত্বে যাত্রা শুরু করে অটোমান সাম্রাজ্য, যা পরবর্তীতে ইসলামী বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও দীর্ঘস্থায়ী খিলাফতে রূপ নেয়। অটোমান শাসনের শ্রেষ্ঠ অর্জন ছিল কনস্টান্টিনোপল বিজয়, যা ১৪৫৩ সালে সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ-এর নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়।
অটোমানরা শুধু শাসকই ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন জ্ঞান, স্থাপত্য, চিকিৎসা ও শিক্ষা বিস্তারে অগ্রণী। তবে পরবর্তীতে প্রশাসনিক জটিলতা, প্রযুক্তিগত পিছিয়ে পড়া ও ঋণের বোঝা এই সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে তোলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ১৯২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অটোমান খিলাফতের অবসান ঘটে।
খিলাফতের পতনের পর মুসলিম বিশ্বে শুরু হয় পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসনের যুগ। ইসলামী ভূখণ্ডগুলোকে বিভাজিত করে ছোট ছোট রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। তবে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে এসব দেশ ধীরে ধীরে স্বাধীনতা অর্জন করে।
বর্তমানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর আন্তর্জাতিক সংগঠন ওআইসি (OIC)-এর সদস্য সংখ্যা ৫৭টি। এরা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এর বাইরেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে অগণিত মুসলিম জনগোষ্ঠী—যারা ইসলামী ইতিহাসের উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে চলছে বৈচিত্র্য ও বিস্তারের নতুন ধারায়।
আপনার মতামত লিখুন