
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিটি জেলা গঠনের পেছনে রয়েছে নির্দিষ্ট জনঅভিপ্রায়, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও উন্নয়নভিত্তিক যুক্তি। সেই আলোকে বাজিতপুরের জেলা হওয়ার দাবি নতুন কিছু নয়—এটি শতাব্দী পেরোনো একটি জনগণের স্বপ্ন, যা সময়ের আবর্তে বারবার উচ্চারিত হয়েছে, আন্দোলনের ভাষায় গর্জেছে এবং শাসকের টেবিলে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে—কেন বাজিতপুর জেলা হওয়া উচিত? তার উত্তর খুঁজে পেতে আমাদের ফিরতে হবে অতীতে, দেখতে হবে বর্তমানে, এবং ভাবতে হবে আগামী দিনের প্রেক্ষাপটে।
ঐতিহ্যবাহী বাজিতপুর কোনো সাম্প্রতিক আবিষ্কার নয়। এই জনপদের প্রশাসনিক ইতিহাস দীর্ঘ।
১৭৮৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা গঠনের সময় বাজিতপুর তার অংশ হয়।
১৮২৩ সালে বাজিতপুর থানা প্রতিষ্ঠিত হয়—তখনও কিশোরগঞ্জ থানার সৃষ্টি হয়নি।
১৮৬৯ সালে বাজিতপুর পৌরসভা গঠিত হয়, যা দেশের অন্যতম প্রাচীন পৌরসভা।
১৮৬৭ সালে এখানে দেওয়ানী আদালত চালু হয়।
১৮৭২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাজিতপুরে জনসংখ্যা ছিল ১,৫৬,৭৯১—যা সে সময়কার প্রেক্ষিতে একটি জনবহুল অঞ্চলের নির্দেশক।
১৯১২ সালে ব্রিটিশ সরকার বাজিতপুরকে মহকুমা ঘোষণা করার জন্য ২০৬ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করে। মহকুমা অফিস নির্মাণের কাজও শুরু হয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেই প্রক্রিয়া থমকে যায়। পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে ১৯৫২ সালের বাউন্ডারি কমিশন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৮ সালের কমিশন—সবগুলোই বাজিতপুরকে মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পক্ষে সুপারিশ করে।
এমনকি বাজিতপুর জেলার দাবিকে ঘিরে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস এতটাই গভীর যে, এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় সরকারি প্রতিবেদন, কমিশন রিপোর্ট এবং মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধান চালানো হয়েছে।
বর্তমানে বাজিতপুর উপজেলা কিশোরগঞ্জ জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর আয়তন প্রায় ২০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি, যা বাংলাদেশের বহু জেলার তুলনায় বড়।
বাজিতপুরে রয়েছে ১টি পৌরসভা, ১১টি ইউনিয়ন এবং শতাধিক গ্রাম।
জনসংখ্যা প্রায় ৩ লাখেরও বেশি। অর্থাৎ, এটি এমন একটি উপজেলা, যেখানে জনসংখ্যা এবং ঘনত্ব দুইই উচ্চমাত্রার।
বাজিতপুর দক্ষিণে ভৈরব, পূর্বে কুলিয়ারচর, পশ্চিমে কটিয়াদি ও পাকুন্দিয়া—এই চারটি উপজেলাকে কেন্দ্র করেই একটি পূর্ণাঙ্গ জেলা গঠন অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও সহজ। এতে করে হাওর অঞ্চলের মানুষের প্রশাসনিক কার্যক্রম অনেক সহজ হবে এবং জেলা সদর পর্যন্ত পৌঁছাতে দুর্ভোগ কমবে।
বাজিতপুরে অবস্থিত জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল দেশের অন্যতম সেরা বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। এই হাসপাতাল শুধু বাজিতপুর নয়, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, নিকলী ও হোসেনপুরের রোগীদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য চিকিৎসাকেন্দ্র।
এছাড়া রয়েছে বাজিতপুর সরকারি কলেজসহ বহু উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা এবং টেকনিক্যাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে এত বড় অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও বাজিতপুর আজও শুধুমাত্র একটি উপজেলা—এটি নিঃসন্দেহে একটি বৈষম্য।
বাজিতপুর রেলওয়ে জংশন দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম রুটে চলাচলের জন্য এটি একটি অপরিহার্য পয়েন্ট।
সড়ক ও নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থাও তুলনামূলকভাবে উন্নত।
এছাড়াও বাজিতপুর একটি অর্থনৈতিক হাব হিসেবে দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে—বাজার, ব্যবসা, কৃষিপণ্য পরিবহন, হাওর অঞ্চল থেকে সরবরাহ, সবমিলিয়ে এটি এক স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল।
২০১০ সালে যখন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ভৈরবকে জেলা করার গুঞ্জন তোলেন, তখন বাজিতপুরবাসী রাস্তায় নেমে আসে।
নৌপথ, সড়কপথ, রেলপথ অবরোধ করে তারা জানিয়ে দেয়—"জেলা যদি হয়, বাজিতপুরই হবে!"
হরতাল, বিক্ষোভ, অবস্থান কর্মসূচি, অনশন—সবই হয়েছে এই দাবির পক্ষে।
যুগে যুগে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাধারণ জনগণ, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, এমনকি প্রবাসীরাও।
স্বাধীনতা-উত্তর কালে জিয়াউর রহমান বাজিতপুর জেলা গঠনের জন্য জেলা প্রশাসককে তদন্ত রিপোর্ট দিতে বলেন। সে রিপোর্টে বাজিতপুরকে ৬টি উপজেলাসম্পন্ন জেলা হিসেবে প্রস্তাব করা হয়।
পরবর্তীতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে আবারও আলোচনায় আসে বাজিতপুর জেলা।
আলহাজ্ব জহুরুল ইসলাম ছিলেন এই দাবির অন্যতম কাণ্ডারি। কিন্তু নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েনে আজও সেই দাবি বাস্তব হয়নি।
বাজিতপুর জেলা হওয়া মানে শুধু একটি প্রশাসনিক নাম বদল নয়—এটি একটি জনপদের ন্যায্য দাবি পূরণ, ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা এবং জনসেবার উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
সব প্রক্রিয়া, সব অবকাঠামো, সব জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও বাজিতপুর আজও একটি উপেক্ষিত জনপদ হয়ে রয়ে গেছে। আর নয়। সময় এসেছে সত্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার।
বাজিতপুর জেলা—এটা কোনো দাবি নয়, এটা আমাদের জন্মগত অধিকার।
এই অধিকার আদায়ের আন্দোলন থামবে না, যতক্ষণ না বাস্তবায়ন হয় প্রাচীন জনপদ বাজিতপুর জেলার স্বপ্ন।
রোববার, ২৪ আগস্ট ২০২৫
প্রকাশের তারিখ : ২৯ জুলাই ২০২৫
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিটি জেলা গঠনের পেছনে রয়েছে নির্দিষ্ট জনঅভিপ্রায়, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও উন্নয়নভিত্তিক যুক্তি। সেই আলোকে বাজিতপুরের জেলা হওয়ার দাবি নতুন কিছু নয়—এটি শতাব্দী পেরোনো একটি জনগণের স্বপ্ন, যা সময়ের আবর্তে বারবার উচ্চারিত হয়েছে, আন্দোলনের ভাষায় গর্জেছে এবং শাসকের টেবিলে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে—কেন বাজিতপুর জেলা হওয়া উচিত? তার উত্তর খুঁজে পেতে আমাদের ফিরতে হবে অতীতে, দেখতে হবে বর্তমানে, এবং ভাবতে হবে আগামী দিনের প্রেক্ষাপটে।
ঐতিহ্যবাহী বাজিতপুর কোনো সাম্প্রতিক আবিষ্কার নয়। এই জনপদের প্রশাসনিক ইতিহাস দীর্ঘ।
১৭৮৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা গঠনের সময় বাজিতপুর তার অংশ হয়।
১৮২৩ সালে বাজিতপুর থানা প্রতিষ্ঠিত হয়—তখনও কিশোরগঞ্জ থানার সৃষ্টি হয়নি।
১৮৬৯ সালে বাজিতপুর পৌরসভা গঠিত হয়, যা দেশের অন্যতম প্রাচীন পৌরসভা।
১৮৬৭ সালে এখানে দেওয়ানী আদালত চালু হয়।
১৮৭২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাজিতপুরে জনসংখ্যা ছিল ১,৫৬,৭৯১—যা সে সময়কার প্রেক্ষিতে একটি জনবহুল অঞ্চলের নির্দেশক।
১৯১২ সালে ব্রিটিশ সরকার বাজিতপুরকে মহকুমা ঘোষণা করার জন্য ২০৬ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করে। মহকুমা অফিস নির্মাণের কাজও শুরু হয়। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেই প্রক্রিয়া থমকে যায়। পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে ১৯৫২ সালের বাউন্ডারি কমিশন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৮ সালের কমিশন—সবগুলোই বাজিতপুরকে মহকুমা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পক্ষে সুপারিশ করে।
এমনকি বাজিতপুর জেলার দাবিকে ঘিরে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের ইতিহাস এতটাই গভীর যে, এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় সরকারি প্রতিবেদন, কমিশন রিপোর্ট এবং মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধান চালানো হয়েছে।
বর্তমানে বাজিতপুর উপজেলা কিশোরগঞ্জ জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর আয়তন প্রায় ২০০ বর্গকিলোমিটারের বেশি, যা বাংলাদেশের বহু জেলার তুলনায় বড়।
বাজিতপুরে রয়েছে ১টি পৌরসভা, ১১টি ইউনিয়ন এবং শতাধিক গ্রাম।
জনসংখ্যা প্রায় ৩ লাখেরও বেশি। অর্থাৎ, এটি এমন একটি উপজেলা, যেখানে জনসংখ্যা এবং ঘনত্ব দুইই উচ্চমাত্রার।
বাজিতপুর দক্ষিণে ভৈরব, পূর্বে কুলিয়ারচর, পশ্চিমে কটিয়াদি ও পাকুন্দিয়া—এই চারটি উপজেলাকে কেন্দ্র করেই একটি পূর্ণাঙ্গ জেলা গঠন অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও সহজ। এতে করে হাওর অঞ্চলের মানুষের প্রশাসনিক কার্যক্রম অনেক সহজ হবে এবং জেলা সদর পর্যন্ত পৌঁছাতে দুর্ভোগ কমবে।
বাজিতপুরে অবস্থিত জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল দেশের অন্যতম সেরা বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। এই হাসপাতাল শুধু বাজিতপুর নয়, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, নিকলী ও হোসেনপুরের রোগীদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য চিকিৎসাকেন্দ্র।
এছাড়া রয়েছে বাজিতপুর সরকারি কলেজসহ বহু উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা এবং টেকনিক্যাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে এত বড় অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও বাজিতপুর আজও শুধুমাত্র একটি উপজেলা—এটি নিঃসন্দেহে একটি বৈষম্য।
বাজিতপুর রেলওয়ে জংশন দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম রুটে চলাচলের জন্য এটি একটি অপরিহার্য পয়েন্ট।
সড়ক ও নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থাও তুলনামূলকভাবে উন্নত।
এছাড়াও বাজিতপুর একটি অর্থনৈতিক হাব হিসেবে দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে—বাজার, ব্যবসা, কৃষিপণ্য পরিবহন, হাওর অঞ্চল থেকে সরবরাহ, সবমিলিয়ে এটি এক স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল।
২০১০ সালে যখন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ভৈরবকে জেলা করার গুঞ্জন তোলেন, তখন বাজিতপুরবাসী রাস্তায় নেমে আসে।
নৌপথ, সড়কপথ, রেলপথ অবরোধ করে তারা জানিয়ে দেয়—"জেলা যদি হয়, বাজিতপুরই হবে!"
হরতাল, বিক্ষোভ, অবস্থান কর্মসূচি, অনশন—সবই হয়েছে এই দাবির পক্ষে।
যুগে যুগে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাধারণ জনগণ, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, এমনকি প্রবাসীরাও।
স্বাধীনতা-উত্তর কালে জিয়াউর রহমান বাজিতপুর জেলা গঠনের জন্য জেলা প্রশাসককে তদন্ত রিপোর্ট দিতে বলেন। সে রিপোর্টে বাজিতপুরকে ৬টি উপজেলাসম্পন্ন জেলা হিসেবে প্রস্তাব করা হয়।
পরবর্তীতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে আবারও আলোচনায় আসে বাজিতপুর জেলা।
আলহাজ্ব জহুরুল ইসলাম ছিলেন এই দাবির অন্যতম কাণ্ডারি। কিন্তু নানা রাজনৈতিক টানাপোড়েনে আজও সেই দাবি বাস্তব হয়নি।
বাজিতপুর জেলা হওয়া মানে শুধু একটি প্রশাসনিক নাম বদল নয়—এটি একটি জনপদের ন্যায্য দাবি পূরণ, ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা এবং জনসেবার উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
সব প্রক্রিয়া, সব অবকাঠামো, সব জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও বাজিতপুর আজও একটি উপেক্ষিত জনপদ হয়ে রয়ে গেছে। আর নয়। সময় এসেছে সত্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার।
বাজিতপুর জেলা—এটা কোনো দাবি নয়, এটা আমাদের জন্মগত অধিকার।
এই অধিকার আদায়ের আন্দোলন থামবে না, যতক্ষণ না বাস্তবায়ন হয় প্রাচীন জনপদ বাজিতপুর জেলার স্বপ্ন।
আপনার মতামত লিখুন